গুলিবিদ্ধ জাহেদুল এখন মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছেন। জীবন কাটছে বাড়ির চার দেয়ালের মধ্যে। অভাবের তাড়নায় জাহেদুল আলম লেখাপড়া রেখেই ঢাকা গিয়েছিলেন চাকরী করে সংসারের হাল ধরবেন। কিন্তু সে আশায় গুড়ে বালি বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে গিয়ে পেটে ও পায়ে গুলি লেগে অবশেষে ফিরলেন সংসারের বোঝা হয়ে।
জয়পুরহাটের ক্ষেতলাল উপজেলার কানাইপুকুর গ্রামের দিনমজুর আব্দুল জলিলের ছেলে জাহেদুল ইসলাম (২১)। তিন ভাইয়ের মধ্যে সবার বড় জাহেদুল। ২০২২ সালের গ্রামের পাশে দুপচাঁচিয়া কারিগরি কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করে আবার ওই কলেজেই অনার্সে ভর্তি হন। কিন্তু অভাবের সংসারে দিন যেখানে চলে না সেখানে কলেজেও যাওয়া হয়না। দিনমজুর বাবা-মায়ের কষ্ট দেখে বিবেকের তাড়নায় লেখাপড়া রেখেই ৬ মাস আগে ঢাকা চলে যান চাকরী করতে। যাত্রাবড়ি এলাকায় প্যাকেজিং ফ্যাক্টরিতে কার্টুন তৈরির কাজ নেন। বাবা আব্দুল জলিল (৫৮) ও মা হাসনা বেগম (৪৩) ছেলে চাকরি করছে এতে খুশি হলেও সেই আনন্দ বেশি দিন ধরে রাখতে পারেননি জাহেদুল।
৫ আগস্ট বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে গিয়ে গুলিবিদ্ধ জাহেদুল এখন মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছেন। জীবন কাটছে বাড়িতে চার দেয়ালের মধ্যে। ফলো আপ চিকিৎসার জন্য ডাক্তার আবার ঢাকা সিএমএইচে যেতে বললেও টাকা অভাবে পরিবার জাহেদুলকে আর ঢাকা নিয়ে যেতে পারছে না।
জাহেদুল জানান, ৫ আগস্ট অফিস খোলা থাকায় সেখানে গিয়ে শুনি শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেছে। সেই আনন্দে যাত্রাবাড়ীতে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আনন্দ মিছিল বের হলে আমিও সেই মিছিলে যোগ দেই। মিছিলের মধ্যে গুলিবিদ্ধ হয়ে গুরুতর আহত হন জাহেদুল। তার পেটে দুটি ও দুই পায়ে দুটি মোট চারটি গুলি লাগে। পেটে লাগা গুলি পায়খানা দ্বারের নিচ দিয়ে মূত্রথলি ছিঁড়ে বের হয়ে যায়। এ অবস্থায় তাকে প্রথমে সলিমুল্লাহ মিটফোর্ড হাসপাতালে ভর্তির পর গুলি বের করে ব্লাডার ইনজুরির অপারেশন করে ব্যর্থ হয় চিকিৎসকরা। তখন তাকে অন্য ওয়ার্ডে শিফট করা হয়। ১৫দিন পর তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য সিএমএইচ হাসপাতালে নিয়ে চারদিন আইসিইউতে রাখা হয়। ২২ আগস্ট সেখানে তার ব্লাডার ইনজুরির সফল অপারেশন হয়। এজন্য ১৪ দিন তাকে আবারো আইসিইউতে থাকতে হয়। এক মাস ১৭ দিন উন্নত চিকিৎসা দিয়ে সরকারি খরচে জহেদুলকে বাড়ি পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়।
পরিবারের পক্ষে গুরুতর আহত জাহেদুলের চিকিৎসা করার মত সামর্থ্যও নেই। ছেলের চিকিৎসা ও পরিবারের খরচ জোগাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে দিনমজুর বাবা আব্দুল জলিলকে।
প্রতিবেশী সম্পর্কে চাচাতো ভাই জামাল প্রামানিক বলেন, জাহেদুল ছোট বেলা থেকে কষ্ট করেই বড় হয়েছে। নিজে দিনমজুরের কাজ করে লেখাপড়া করতো। খুবই অসহায় পরিবার। পিতা দিনমজুরের কাজ করে কোন মতে সংসার চালায়। টাকা অভাবে ছেলের চিকিৎসা করতে পারছে না। আরেক প্রতিবেশী রেবেকা খাতুন বলেন, ছোট বেলা থেকে জাহেদুল অন্যের জন্য ভাবতো ভালো চিন্তা করতো। সুন্দর কর্মঠ একটা ছেলে জাহেদুল বর্তমানে এ অবস্থা দেখে আমাদের খুব খারাপ লাগছে।
অসুস্থ মা হাসনা বেগম জানান, তিন ছেলের মধ্যে জাহেদুল সবার বড়। অভাবের সংসারে ছোট বেলা থেকে নিজের খরচ নিজেই চালিয়ে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে বগুড়ার দুপচাঁচিয়া কারিগরি কলেজে ম্যানেজমেন্টে অনার্সে ভর্তি হয়। কিন্তু সংসারের অভাব দুর করতে জাহেদুল ঢাকাতে যায়। সাইনবোর্ড এলাকায় দুই বন্ধু প্রিন্ট এন্ড প্যাকেজিং প্রতিষ্ঠানে সুপারভাইজার পদে ১৩ হাজার টাকা মাসিক বেতনে চাকরি নেয় । সেখান থেকে প্রতিমাসে সংসার খরচের জন্য জাহেদুল তার বাবাকে পাঁচ হাজার টাকা পাঠাতো। সেই থেকে ভালোই চলছিল পরিবার। কিন্তু হঠাৎ করে ছন্দপতন ঘটে সংসারে।
জাহেদুল জানায়, হাসপাতালেই ভালো ছিলাম। বাড়ি আসার পর কিছু খেতে পারছি না। প্রস্রাব করতেও পারছি না। কখনো কখনো কাপড় ভিজে যাচ্ছে। কিছু খেলেই শরীরের সাথে বেধে দেওয়া নল দিয়ে খাবারের থলিতে জমা হচ্ছে। যেগুলো মাঝে মধ্যেই পরিষ্কার করতে হচ্ছে। শরীর খুবই দুর্বল। কথা বলতেও কষ্ট হচ্ছে। সংসারে আমিই ছিলাম একমাত্র ভরসা। কিন্তু অসুস্থতার কারণে আমিই এখন সংসারের বোঝা হয়ে গেলাম। বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক সারজিস আলম হাসপাতালে দেখতে এসে ৫০ হাজার টাকা দিয়েছিলেন। এরপর আর কোন সহযোগিতা মেলেনি, তেমন কেউ খোঁজ খবরও নেয়না। দরিদ্র বাবার পক্ষে আমার চিকিৎসা মেটানো সম্ভব নয়। ঢাকায় যে আবার চিকিৎসা নিতে যাব,অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করার মত সামর্থ আমাদের নেই।
জাহেদুলের বাবা আব্দুল জলিল বলেন, ‘আমি গরিব মানুষ। বাড়ি ভিটা ছাড়া আর সম্পদ বলতে কিছুই নাই। বৃদ্ধ বয়সে অন্যের বাড়িতে কাজ করে সংসার চালাই। ছেলেটা অসুস্থ হওয়ার পর থেকে আমি ঢাকায় তার সাথে ছিলাম। তখন আমার পরিবার খেয়ে না খেয়ে দিন কাটিয়েছে। টাকা অভাবে চিকিৎসা করতে না পারায় ছেলেটাকে বোধ হয় আর বাঁচাতে পারবো না। চিকিৎসা অভাবে দিন দিন শুকিয়ে যাচ্ছে। ডাক্তার ভালো খাবারের কথা বলেছেন। কিন্তু টাকা অভাবে ছেলেটাকে ভালো খাবার দিতে পারি না। আমি এখন কি করবো ভেবে পাচ্ছি না। বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে গিয়ে গুলিতে গুরুতর আহত বড় ছেলে জাহেদুলকে বাঁচাতে চিকিৎসার জন্য সরকারসহ সমাজের বিত্তবানদের কাছে সহায়তা চেয়েছেন দিনমজুর পিতা আব্দুল জলিল। (জাহেদুলের বাবা আব্দুল জলিল মোবাইল নং ০১৭৪১-৪৫৪৫৪২)
মন্তব্য করুন