admin
৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ৫:১৭ পূর্বাহ্ন
অনলাইন সংস্করণ

খাবার টেবিলে হাসি-আনন্দ ছিল দুই মেয়ে ও স্বামীর সঙ্গে রিহাবের শেষ স্মৃতি

লেবাননে ইসরায়েলি বাহিনীর বোমা থেকে বাঁচতে গত বছর প্রথমবার নিজ বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছিলেন রিহাব ফাউর। কিছুদিন পর তিনি আবার পালাতে বাধ্য হন। এভাবে গত এক বছরে চারবার ঘর ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন। আর এ সময়ের মধ্যে তিনি কখনো লেবাননের কোথাও নিরাপদ বোধ করেননি।

রিহাবের বাস্তুচ্যুত হওয়ার দুঃসহ যাত্রার শুরু ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবরের পর, যখন ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাস ইসরায়েলে আক্রমণ করেছিল। এ আক্রমণের প্রতিশোধ নিতে ওই দিনই গাজায় ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ শুরু করে ইসরায়েল, যা আজও থামেনি।

ইসরায়েলের নৃশংসতার প্রতিবাদে লেবাননের সশস্ত্র গোষ্ঠী হিজবুল্লাহ ইসরায়েলে রকেট হামলা চালায়। জবাবে ইসরায়েলও লেবানন সীমান্তে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা করে। বেশ কয়েক মাস ধরে চলে পাল্টাপাল্টি হামলা। এরপর চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে লেবাননে হামলা জোরদার করে ইসরায়েল। বিমান থেকে গোলা নিক্ষেপ ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলার পাশাপাশি দেশটি শুরু করে স্থল অভিযানও। এক বছরের বেশি সময় ধরে লেবাননে ইসরায়েলি আগ্রাসনে নিহত হয়েছেন কয়েক হাজার মানুষ।

গত বছর প্রথমবার যখন রিহাবের গ্রামের খুব কাছে বোমা নিক্ষেপ করা হয়, তখন ৩৩ বছর বয়সী এই নারী এবং তাঁর স্বামী সাঈদ তাঁদের দুই মেয়ে টিয়া (৮) ও নায়াকে (৬) নিয়ে বাড়ি ছেড়ে পালান। লেবাননের রাজধানী বৈরুতের শহরতলি দাহিয়েহে রিহাবের বাবার বাড়িতে গিয়ে আশ্রয় নেন তাঁরা।

দাহিয়েহে যাওয়ার পর টিয়া ও নায়া তাদের বন্ধুদের শূন্যতা অনুভব করতে শুরু করে। বাড়িতে রেখে আসা খেলনা, নিজেদের বিছানা-জামাকাপড়ের কথা ভেবে মন খারাপ হয়। তবে পরিবারটি ভেবেছিল, বোমা হামলার ভয় হয়তো বেশি দিন তাড়া করবে না তাদের। শিগগিরই জীবন আবারও স্বাভাবিক ধারায় ফিরবে। কিন্তু কিছুদিন পরই পরিবারটি বুঝতে পারে, সে আশায় গুঁড়েবালি।

স্কুলের কথা মনে পড়লে বেশি মন খারাপ হতো ছোট্ট টিয়া ও নায়ার। তাই গত আগস্টে রিহাব দুই মেয়েকে বৈরুতের একটি স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেন। কিনে দেন নতুন ইউনিফর্ম। নতুন স্কুল ও ইউনিফর্ম পেয়ে বেশ খুশিই হয়েছিল টিয়া ও নায়া। কিন্তু স্কুল শুরু হওয়ার আগেই বৈরুতে বোমা হামলা জোরদার করে ইসরায়েল। বিশেষ করে দাহিয়েহ শহরতলিতে তীব্র হামলা চালানো হয়।

ছয় সপ্তাহ পর, বৈরুতের একটি প্লাস্টিকের চেয়ারে বসে ছিলেন রিহাব। তাঁর চোখের নিচে কালি, চেহারায় রাজ্যের বিষণ্নতা। তখনো অস্ত্রোপচারের ধকল পুরোপুরি কাটেনি। তাঁর মেরুদণ্ডে আটটি স্ক্রু বসানো হয়েছে। আরও তিনটি বসানো হয়েছে বাহুতে। অনেক দিন বিছানা থেকেই উঠতেই পারেননি তিনি।

দাহিয়েহে হিজবুল্লাহর শীর্ষস্থানীয় নেতাদের হত্যা করতে অভিযান শুরু করে ইসরায়েল। সে জন্য বাঙ্কারবিধ্বংসী বোমা ব্যবহার করে তারা। প্রতিটি বোমা একেকটি আবাসিক ভবন মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিতে সক্ষম। কখনো হামলার সময় একবারেই কয়েক ডজন বাঙ্কারবিধ্বংসী বোমা নিক্ষেপ করত ইসরায়েল। এতে ধ্বংস হয়ে যেত শহরতলির একেকটি ব্লক।

এমনই একটি হামলার কবলে পড়ে তল্পিতল্পা গুটিয়ে আবার ঘর ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয় রিহাবের পরিবার। এবার তাঁরা বৈরুতের অন্য শহরতলি জানাহরতে একটি বাসা ভাড়া নেন। সেখানেও ভয়াবহ এক বিমান হামলার পর তাঁরা সাঈদের বাবার বাড়ি বারবর শহরতলিতে চলে যান। এই বাড়িতে একসঙ্গে ১৭ জন গাদাগাদি করে থাকা শুরু করেন তাঁরা।

চলতি বছর টিয়া ৯ বছর ও নায়া ৭ বছরে পা দিয়েছে। দাদার বাড়িতে চলে আসার পর তারা বেশ উৎফুল্ল ছিল। কারণ, দিনরাত চাচাতো ভাইবোনেরা তাদের ঘিরে থাকত। রিহাবের বাবা তাঁর মেয়ের পরিবারের জন্য আলাদা একটি বাসা খুঁজে বের করেন। কিন্তু টিয়া ও নায়া তাঁর চাচাতো ভাইবোনকে ছেড়ে সেখানে যেতে রাজি হয়নি। রিহাব স্মৃতিচারণা করে বলেন, ‘নায়া আমাদের সবাইকে সাঈদের বাবার বাড়িতে থেকে যাওয়া অনুরোধ করে। আমরা তাকে বলেছিলাম, শুধু এক রাত ঘুমাতে আমরা একটি নতুন বাড়িতে যাব। রাত শেষে আবার ফিরে আসব।’

ইসরায়েলি বোমার আঘাতে ধসে পড়েছে লেবাননের দক্ষিণ শহরতলির একটি ভবন
ইসরায়েলি বোমার আঘাতে ধসে পড়েছে লেবাননের দক্ষিণ শহরতলির একটি ভবনফাইল ছবি: রয়টার্স

রিহাব দুই মেয়েকে নতুন বাসায় যাওয়ার জন্য রাজি করান। তাদের বলেন, নতুন বাসায় গেলে তারা নিজেদের পছন্দের খাবার খেতে পারবে। নতুন বাসায় যাওয়ার সময় তারা পথে গাড়ি থামিয়ে একটি দোকান থেকে বিভিন্ন খাবার কেনেন। এরপর পরিবারটি মধ্য বৈরুতের বাস্তা এলাকায় একটি কম ভাড়ার বাসার উদ্দেশে রওনা দেয়। ওই সময়ও রাস্তাঘাট লোকজনের চলাচলে বেশ প্রাণবন্ত ছিল।

ইসরায়েল-হিজবুল্লাহ সাম্প্রতিক সংঘাত শুরুর আগে ২০০৬ সালে দুই পক্ষের মধ্যে যুদ্ধ চলাকালে লেবাননের কিছু নির্দিষ্ট অঞ্চলে বোমা হামলা সীমাবদ্ধ ছিল। সে সময় হামলার লক্ষ্যস্থল ছিল দক্ষিণ দাহিয়েহ ও সেখানকার কিছু অবকাঠামো। এবার হিজবুল্লাহ নেতারা সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছেন। ফলে তাঁরা যেখানে গেছেন, সেখানেই ইসরায়েলি সেনারা বোমা নিক্ষেপ করেছেন। ফলে মধ্য বৈরুতসহ যেসব এলাকা একসময় নিরাপদ বলে মনে হতো, সেসব এলাকায়ও অনিরাপদ হয়ে পড়ে।

নতুন এ বাসা সাঈদের বাবার বাড়ির মতো নয়। সেখানে পানির সমস্যা ছিল না। এ ছাড়া নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুতের জন্য একটি জেনারেটরও ছিল। নতুন বাসায় ওঠার পর কিছুটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেন রিহাব ও সাঈদ। যদিও সেখানেও দূর থেকে ভেসে আসা ইসরায়েলি ড্রোনের শব্দ শুনতে পাচ্ছিলেন তাঁরা। কিন্তু এ শব্দে লেবাননের অন্যান্য বাসিন্দার মতো অভ্যস্ত হয়ে ওঠেন তাঁরা।

নতুন বাসায় উঠে কিছুটা গুছিয়ে নেওয়ার পর টেবিলে খাবার সাজিয়ে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে বসেছিলেন রিহাব। তিনি বলেন, ‘আমরা খেতে বসে কথা বলছিলাম ও হাসাহাসি করছিলাম। আর এটাই ছিল ওদের সঙ্গে আমার শেষ স্মৃতি।’

গত ১০ অক্টোবর রাত ৮টার দিকে রিহাব ও তাঁর পরিবার জানাহর ওই বাসায় ওঠার আধঘণ্টা পর ভবনটিতে ইসরায়েলি বোমা আঘাত হানে। বোমায় ভবনটি গুঁড়িয়ে যায়। এ সময় ২২ জন নিহত হন, যা ছিল মধ্য বৈরুতে এক বছরের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ হামলার ঘটনা।

এ হামলার আগে ইসরায়েলি সেনারা কোনো রকম সতর্কতা জারি করেননি। ফলে ভবনটি মানুষে ঠাসা ছিল। হিজবুল্লাহ কমান্ডার ওয়াফিক সাফাকে হত্যার উদ্দেশে এ হামলা চালানো হয়েছিল। তবে নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে তিনি ছিলেন না। হয়তো বেঁচে গেছেন, না হলে ওই ভবনেই ছিলেন না তিনি। তবে এ হামলার বিষয়ে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে।

ওই ঘটনার পর রিহাব চোখ খুলে নিজেকে বৈরুতের জাহরা হাসপাতালে আবিষ্কার করেন। চেতনা ফেরার সঙ্গে সঙ্গে বাহু ও পিঠে নিদারুণ যন্ত্রণা টের পান। মারাত্মকভাবে আহত হয়েছেন তিনি। শরীরে দুটি অস্ত্রোপচার করতে হয়েছে। হাসপাতালের বিছানায় রিহাব বারবার চেতনা হারাচ্ছিলেন। খাবার টেবিলে বসে থাকা অবস্থায় মেয়েদের হাসির দৃশ্য বারবার মনের পর্দায় ভেসে উঠছিল। কিন্তু চোখ খুললেই চারপাশে অসীম শূন্যতা ছাড়া আর কিছুই দেখতে পাচ্ছিলেন না তিনি।

রিহাব ওই রাতে যখন হাসপাতালের বিছানায় কাতরাচ্ছিলেন, তখন বৈরুতের বিভিন্ন হাসপাতালে হন্যে হয়ে সাঈদ ও তাঁর দুই মেয়েকে খুঁজছিলেন অন্য স্বজনেরা। মধ্যরাতে তাঁরা জানতে পারেন, সাঈদ ও টিয়া মারা গেছে। তবে নায়া বেঁচে আছে না মারা গেছে, তা নিশ্চিত হওয়ার জন্য একটি ডিএনএ পরীক্ষা করতে হতো। কারণ, নায়ার বয়সী আরেকটি মেয়েকেও মৃত অবস্থায় হাসপাতালে আনা হয়েছিল। মারাত্মক জখমের কারণে তখন দুজনের পরিচয়ই শনাক্ত করা যাচ্ছিল না।

Facebook Comments Box

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

এজেন্সি প্রতি এক হাজার কোটা বহাল রেখেই সৌদি আরবের সঙ্গে বাংলাদেশের ২০২৫ সনের হজ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে

টঙ্গী ইজতেমার মাঠে সাদপন্থীদের হামলার ঘটনায় জামালপুরে বিক্ষোভ

২০২৫ সালে রওনা দেওয়া বিমানটি পৌঁছায় ২০২৪ সালে

ছাত্রদলের ৪৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী আজ

মাসব্যাপী আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলা শুরু আজ

হবিগঞ্জে কারখানার গ্যাস লাইনে বিস্ফোরণে প্রকৌশলীসহ নিহত ৪

এরা ডামি সরকার বলেই সামান্য ফু দিতেই উড়ে গেছে: ডা. শফিকুর রহমান

সকল ষড়যন্ত্র প্রতিহত করে কাংখিত বিজয়ের জন্য আমাদেরকে কাজ করতে হবে- আমিরে মজলিস

আমাদের উত্তরা ফাউন্ডেশন এর ৪র্থ প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী উদযাপন ও শীত বস্ত্র বিতরণ

গাজীপুর টঙ্গীতে আলোকিত মানুষ গড়ার লক্ষ্যে করণীয় শীর্ষক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত

১০

সন্ত্রাসী আওয়ামীলীগের নেতাকর্মীকে হুশিয়ার করলেন ছাত্রদল নেতা ইমতিয়াজ।

১১

৩ মাসেও শব্দদূষণ কমেনি ঢাকা বিমানবন্দর এলাকায়

১২

অভিষিক্ত কনস্টাসকে কোহলির ধাক্কা, সমালোচনার ঝড়

১৩

যুদ্ধবিরতি চুক্তি নিয়ে পাল্টাপাল্টি দোষারোপ ইসরাইল ও হামাসের

১৪

আ.লীগ দেশের মানুষের রিজিক তুলে নিয়েছে: জামায়াত আমির

১৫

অন্তর্বর্তী সরকারের উদারতা কপালপোড়া জাতিকে অনন্তকাল ভোগাবে: হাসনাত

১৬

যুবদলের নাম ভাংগিয়ে সরকারি জায়গা ও মার্কেট দখলে আবু সাঈদ ও মুরগী সোহেল বেপরোয়া।

১৭

ধামরাইয়ের সাবেক মেয়র কবীর মোল্লাকে ছাত্র হত্যার মামলায় গ্রেফতার করে র‌্যাব,

১৮

২৮ ডিসেম্বর খেলাফত মজলিসের সাধারণ পরিষদের দ্বাদশ অধিবেশন

১৯

রাষ্ট্র মেরামতে বিএনপির ৩১ দফা রূপরেখা

২০